সুলতান ওরহান গাজি
সুলতান ওরহান গাজি(১২৮১-১৩৬০)সুলতান ওরহান গাজি
ওরহান গাজির জন্ম ১২৮১ সালে। তিনি সুলতান ওসমান গাজির প্রথম সন্তান। ওরহান গাজির ময়ের নাম মালহুন হাতুন। আরতুগ্রুল গাজি তার নাম রাখেন ওরহান আল্প অর্থাৎ মহান নেতা। সুলতান হওয়ার পর ওরহান গাজি নিজেকে একজন মহান নেতা হিসেবেই প্রমাণ করেছেন। ওরহান গাজির এক আদেশে শত শত গাজি প্রাণ দিতে সদা প্রস্তুত থাকত। পিতা সুলতান ওসমান গাজির দেখানো পথ অনুসরণ করে তিনি বাইজান্টাইনদের এশিয়া থেকে চিরতরে বিতাড়িত ইউরোপে প্রবেশ করেছিলেন, জয় করেছিলেন অনেকগুলো যুদ্ধ।
এই অনুচ্ছেদটির বাকি অংশ এই মহান গাজিকে নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে।
সুলতান ওরহান গাজির সিংহাসন লাভ:
সুলতান ওসমান গাজি মৃত্যুর সময় তাঁর বড় ছেলে ওরহান গাজিকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে যান। ওরহান গাজি এ দায়িত্ব একা নিতে চাননি। তিনি এ রাজ্যকে তার ভাই আলাউদ্দীন গাজির সাথে ভাগ করে নিতে চাইলেন। কিন্তু আলাউদ্দীন গাজি এ প্রস্তাব নাচক করে দিয়ে ওরহান গাজিকে বললেন আমাদের বাবা সুলতান ওসমান গাজি আপনাকে এ মহান দায়িত্ব দিয়েছেন। সুতরাং আপনিই হবেন এ সালতানাতের একচ্ছত্র অধিপতি। আলাউদ্দীন গাজি ওরহান গাজির কাছ থেকে একটি ছোট জমিদারির জন্য আবেদন করলেন। কিন্তু ওরহান গাজি তার এ আবেদন গ্রহণ না করে তাকে তাঁর ওজিরে আজম হয়ে তার পাশে থাকার অনুরোধ করেন। আলাউদ্দীন গাজি ভাইয়ের এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারেননি। তিনি তার ভাই সুলতান ওরহান গাজির ওজির হিসেবে তার পাশে থাকার অনুরোধ মেনে নিলেন। সালতানাতে ওসমানীয়া এখন দুই ভাইয়ের অধীনে চলবে, একজন সুলতান অপরজন ওজিরে আজম।
পেলেকাননের যুদ্ধ :
সুলতান হয়েই ওরহান গাজি রাজ্যের রাজধানি ইয়েনিশেহির থেকে রুরসায় স্থানান্তর করেন। বুরসা শহরটি বাইজান্টাইন সম্রাজ্যের অন্যতম পুরনো এবং রাজধানী কনস্টান্টিনোপল থেকে খুব কাছের একটি শহর। উদীয়মান ওসমানীয়দের জন্য বুরসায় রাজধানী স্থাপণ রাজনৈতিক দিক থেকে লাভজনক হলেও, সময়ের সাথে ক্ষয়ে যাওয়া বাইজান্টাইনদের জন্য এটি একটি বড় হুমকির স্বরুপ। বুরসায় রাজধানী স্থাপন করেই ওরহান গাজি ১৩২৯ সালে বাইজান্টাইন শহর নিকোমেদিয়া অবরোধ করেন। বাইজান্টাইন সম্রাট ৩য় আদ্রিনিকোস( ১৩২৮-১৩৪১) ৪০০০ হাজার সৈন্য নিয়ে পেলেকানন প্রান্তরে ওরহান গাজির ৮০০০ সৈন্যের মুখোমুখি হন।
যুদ্ধ শুরু হল, প্রথমদিকে ওসমান গাজি আক্রমণের আদেশ দেন, আদেশ পাওয়া মাত্রই গাজিরা শতে শতে বাইজান্টাইন বাহিনীর দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু বাইজান্টাইনরা প্রাচীন গ্রীকদের মতো তাদের লম্বা ঢালগুলো দিয়ে একটি শক্ত ঢালের দেয়াল তৈরি করে ফেললো। এই ঢালের দেয়াল ভেঙে আক্রমণ করতে গিয়ে অনেক ওসমানীয় সৈন্য মারা যাচ্ছিল। এমন সময় ওসমান গাজি তার ঘোরসাওয়ার বাহিনীর একটি দলকে পাঠালেন ঢালের দেয়াল ভাঙার জন্য, বাইজান্টাইনরা এই আক্রমণটাও প্রতিহত করলো। তখন ওসমান গাজি তার বাহিনীকে পিছু হটতে বললেন। বাইজান্টাইনরা ওসমানীয়দের পিছু হটতে দেখে আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে তাদের ধাওয়া করে। এটাই ছিল ওরহান গাজির যুদ্ধ পরিকল্পনা। বাইজান্টাইনরা গাজিদের পিছু ধাওয়া করতে করতে একটি পাহাড়ের খাঁদে এসে পড়ে। এখানেই তারা ওরহান গাজির দক্ষ তীরন্দাজদের তীরের লক্ষে পরিণত হলো। যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল। বাইজান্টাইনরা এবার পলানোর জন্য পিছু হটতে থাকল, কিন্তু ওরহান গাজি তাদের সে সুযোগটা দিলেন না। ওরহান গাজির বাহিনী তাদের ঘিরে ফেলল আর হত্যা করতে লাগল। এই পরিস্থিতিতে সম্রাট আদ্রিনিকোস যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ পালিয়ে গেলেন। ওসমানীয়দের হাতে বাইজান্টাইনদের আরেকটি শহরের পতন হলো। সুলতান ওরহান গাজি সদ্য বিজিত শহরের নাম রাখেন ইজমিত।
শাহাজাদা সুলাইমানের নিকিয়া অবরোধ :
সুলতান ওরহান গাজি নিকোমেদিয়া আক্রমণ করার আগে ১৩২৮ সালের শেষের দিকে তার ছেলে সুলেমান পাশাকে বাইজান্টাইনদের আরেকটি বিখ্যাত শহর নিকিয়া অবরোধ করার জন্য অভিযানে পাঠিয়েছিলেন। সুলেমান পাশা যখন নিকিয়া অবরোধ করেন এর কিছিদিন পরেই সুলতান ওরহান গাজি নিকোমেদিয়া আক্রমণ করেন। ফলে বাইজান্টাইনরা দিধা-দন্দে পড়ে যায় যে কাকে আগে মোকাবেলা করবে। অবশেষে সম্রাট ২য় আদ্রিনিকোসের ছেলে ৩য় আদ্রিনিকোস সুলতান ওরহান গাজিকে মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ওরহান গাজির সাথে যুদ্ধে সম্রাট পরাজিত ও আহত হয়। ফলে নিকিয়ার শাসক আর কোনো উপায় না দেখে দীর্ঘ চার বছর অবরোধ মোকাবেলা করে অবশেষে ১৩৩১ সালে সুলেমান পাশার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ওসমানীয়দের হাতে এখন আরেকটি বাইজান্টাইন শহরের পতন হলো। এই শহরের নাম হলো ইজনিক। এখন আনাতোলিয়ায় বাইজান্টাইনদের কোন কর্তৃত্ব রইলনা। বাইজান্টাইনরা আর কোনদিন ইউরোপের দরজা বলে খ্যাত আনাতলিয়ায় ফিরে আসতে পারেনি।
বাইজান্টাইন সম্রাজ্যে গৃহ যুদ্ধ :
নিকোমেদিয়া ও নিকিয়া বিজয় করে সুলতান ওরজান গাজি তার সম্রাজ্যকে পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত নিলেন ফলে প্রায় দশ বছরেরও অধিক সময় যাবত বাইজান্টাইনদের সাথে ওসমানীয়দের সরাসরি কোন যুদ্ধ হয়নি। তবে ১৩৪১ সালে বাইজান্টাইন সম্রাট ৩য় আদ্রিনিকোস পালাইওলোগোস মারা গেলে তার ছেলে ৫ম জন আট বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন। কিন্তু মাত্র দুই বছর পর ১৩৪৩ সালে জন কান্তাকুজিনো শিশু সম্রাটকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে সম্রাজ্যের নতুন সম্রাট হন। ইতিহাসে তাকে ৬ষ্ঠ জন কান্তাকুজিনো বলা হয়। ওরহান গাজির সাহয্যে কান্তাকুজিনো ক্ষমতায় বসতে পেরছিলো। ওরহান গাজি তাকে সৈন্যদিয়ে সাহায্য করেছিলেন। ১৩৫২ সাল পর্যন্ত কান্তাকুজিন বাইজানটাইন সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে জন কান্তাকুজিনো তার মেয়ে থিওডোরাকে ওরহানের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন।
দেমোটিকের যুদ্ধ :
জন কান্তাকুজিনোর শাসনের সময় বাইজান্টাইন সম্রাজ্যের উত্তরে মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, বসনিয়া,হাঙ্গেরির ও গ্রীসের একটি বড় অংশ নিয়ে স্টিফেন দুশান দ্যা মাইটি একটি সার্বিয়ান সম্রাজ্য গঠন করে ফেলেন। এমন সময় ১৩৫২ সালে ক্ষমতাচ্যুত বাইজান্টাইন শাসক ৫ম জন স্টিফেন দুশানকে সাহয্যের জন্য অনুরোধ করেন। স্টিফেন দুশান জনকে সাহায্য করার তৎক্ষনাৎ ৪০০০ সৈন্য পাঠালেন। এদিকে ৫ম জন ও সার্বদের ঠেকাতে জন কান্তাকুজিনো সুলতান ওরহান গাজিকে সহায্যের জন্য অনুরোধ করেন। আনাতোলিয়া থেকে ইউরোপে প্রবেশ করার জন্য এমনই একটি সুযোগ খুজছিলেন ওসমানীয় সুলতান। ওরহান গাজি সুলেমান পাশার নেতৃত্বে ১০০০০ সৈন্য পাঠালেন কান্তাকুজিনোকে সাহায্য করার জন্য। ওরহান গাজির উদ্দেশ্য হচ্ছে কনস্টান্টিনোপলকে ওসমানীয়দের একটি করদ রাজ্যে পরিণত করা, অপরপক্ষে স্টিফেন দুশানের উদ্দেশ্য হলো একে একে বেলগ্রেড, থেসালোনিকা ও কনস্টান্টিনোপল জয় করে ক্রুসেডে নেতৃত্ব দিয়ে আনাতোলিয়া থেকে ওসমানীয়দের বিতাড়িত করা। কিন্তু স্টিফেন দুশানের এ শখ কখনো পূরণ হয়নি। সুলেমান পাশার নেতৃত্বে ওসমানীয় বাহিনী দেমোটিকার প্রান্তরে সার্বদের মুখোমুখি হলো। যুদ্ধ শুরু হলে সুলেমান পাশা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন। প্রথমদিকে ওসমানীয় বাহিনী শক্ত বর্মপরা নাইটদের অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে কুলিয়ে ওঠতে পারছিলনা। আসলে এটা একটা ফাঁদ ছিল। সার্ব সৈন্যরা যখনই দেখল ওসমানীয়রা পিছু হঠছে তখন তারা তাদের ধাওয়া করতে লাগলো। ওসমানীয় সৈন্যরা পিছু হটতে হটতে একটা জায়গায় এসে থেমেগেল। তাদের এমন পিছু ছোটার মূল উদ্দেশ্য ছিল সার্ব বাহিনীকে ওসমানীয়দের দূর পাল্লার ধনুকের স্বীকার বানানো। সর্বরা ওসমানীয় তীরের সীমার মধ্যে ঢুকতেই শুরু হলো ওসমানীয় গাজিদের তীরের বর্ষন। সর্বিয়ান সৈন্যরা মারা পড়তে লাগলো। সর্বরা হতভম্ব হয়ে দেখছিল ওসমানীয়দের তীর এত দূর কীভাবে পৌছায়। এমন সময় সুলেমান পাশা হাকদির আল্লাহ, বিসমিল্লাহ বলে হুঙ্কার দিয়ে নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন আর সার্বদের ঘিরে ফেললেন। যুদ্ধ শেষ হলো, মৃত লাশে ভরে গেল দেমোটিকার ময়দান, বেশিরভাগ লাশই ছিল সার্ব সৈন্যদের। ৪০০০ সার্ব সৈন্যের মধ্যে খুব অল্প সংখক সৈন্যই ফিরে যেতে পেরেছিল। সার্বদের হারিয়ে দিয়ে সুলেমান পাশা গালিপলি ও জিম্পি দখল করে নিলেন। দেমোটিকার যুদ্ধ ছিল ইউরোপে ওসমানীয়দের প্রথম যুদ্ধ। গালিপলি ও জিম্পি হলো ওসমানীয়দের বিজিত প্রথম ইউরোপীয় অঞ্চল। কান্তাকুজিনো কোন বাইজান্টাইন সৈন্য ছাড়াই আবার কনস্টান্টিনোপলের শাসক হলেন। নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করে একরাশ স্মৃতি নিয়ে সুলেমান পাশা বুরসায় ফিরে আসলেন আর সিদ্ধান্ত নিলেন নিজে সুলতান হলে কনস্টান্টিনোপল জয়ের জন্য আবার এখানে আসবেন। সার্বদের এমন হার মেনে নিতে পারেননি স্টিফেন দুশান। তাই তিনি বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে ওসমানীয়দের মোকাবিলার জন্য আনাতোলিয়ার পথ ধরলেন, কিন্তু পথিমধ্যে প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৪৫ বছর বয়সে মারা যান স্টিফেন দুশান।
কান্তাকুজিনের সাথে সুলতান ওরহান গাজির সম্পর্কের অবনতি :
সুলেমান পাশা গালিপলি ও জিম্পি দখল করে নিলে জন কান্তাকুজিনো অত্যন্ত রেগে গিয়ে ওরহান গাজিকে তা ফিরিয়ে দিতে বলেন। সুলতান ওরহান গাজি বলেন এ জায়গা আল্লাহ আমায় দান করেছেন তোমাকে কিভাবে ফিরিয়ে দেই। কান্তাকুজিনোর পক্ষে যুদ্ধ করে ওসমানীয়দের হাত থেকে গালিপলি ও জিম্পি ফিরিয়ে আনা অসম্ভব ছিল।
অন্যদিকে গালিপলি ও জিম্পি হাতছাড়া হওয়ায় জনগন বিদ্রোহ করে কান্তাকুজিনোকে ক্ষমতাচ্যুত করে ৫ম জনকে পুনরায় সিংহাসনে বসায়। ৫ম জন ক্ষমতায় পুনর্বহাল হয়ে কান্তাকুজিনোকে সন্নাসী হতে বাধ্য করে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন।
সুলতান ওরহান গাজির মৃত্যু :
ইউরোপে অভিযান সম্পন্ন করে সুলেমান পাশা একদিন শিকারে গিয়ে ঘোরার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যু বরণ করেন। নিজের প্রিয় ছেলে যাকে তিনি পরবর্তী সুলতান ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন তার এমন মৃত্যুতে বৃদ্ধ ওরহান গাজি অনেক ভেঙে পড়েন এবং ১৩৬০ সালে তিনিও ইন্তিকাল করেন।
তাঁর দীর্ঘ তেত্রিশ বছরের শাসনকলে তিনি পিতার রেখে যাওয়া ছোট্ট রাজ্যটিকে আনাতোলিয়ার সবচেয়ে বড়, শক্তিশালী ও ধনি সম্রাজ্যে পরিণত করেন। মৃত্যুর আগে তিনি ২য় পুত্র মুরাদ গাজিকে এই সম্রাজ্যের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যান।
0 মন্তব্যসমূহ